বিনা কারণে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হলে যা করবেন
পুলিশকে বলা হয়ে থাকে জনগনের বন্ধু। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কিত
কিছু ঘটনায় পুলিশের সেই ভাবমূর্তি ম্লান হয়ে উঠেছে। মাহান মুক্তিযুদ্ধ’
বাংলাদেশ পুলিশের ট্র্যাডিশনাল চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো।
দেশের জন্য প্রয়োজনে রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিলেন তারা। কিন্তু সাম্প্রতিক
সময়ে জনগণের জানমাল ও সম্পদের হেফাজত না করে পুলিশের কিছু অংশ সাধারণ
মানুষকে নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে।
পুলিশি নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে বা পুলিশি হয়রানির পর করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ।
‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩’ অনুসারে ঘটনা
সংশ্লিষ্ট অভিযোগ যে কেউ দাখিল করতে পারবেন। এই আইনের অধীনে ‘অভিযোগকারী’
হতে পারেন অভিযোগ উত্থাপনকারী বা ভুক্তভোগী উভয়ে। ‘ক্ষতিগ্রস্ত অথবা
সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ অর্থ ওই ব্যক্তি যাকে এই আইনের অধীনে তার উপর অথবা তার
সংশ্লিষ্ট বা উদ্বিগ্ন এমন কারো উপর নির্যাতন করা হয়েছে।
কার কাছে অভিযোগ দাখিল করবেন: ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা
তার পক্ষে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে
পদস্থ নয় এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করতে
পারবেন। অভিযোগ দাখিলের পর পুলিশ সুপার অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ
দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন। অভিযোগ
দাখিলের পর থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যথায়
উপযুক্ত কারণ দেখা দিয়ে অতিরিক্ত আরো ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই মামলা শেষ করার
বিধান রয়েছে।
এছাড়াও কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্যাতন করেছে বা করছে এরকম
কোনো তথ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর
বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে উক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান
করবেন।
আইনত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে: আইন অনুসারে ‘আইন প্রয়োগকারী
সংস্থা’ অর্থ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ,
কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা
শাখা, আনসার ভিডিপি ও কোস্টগার্ডসহ দেশে আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী সরকারি কোনো
সংস্থা অর্থাৎ ‘সশস্ত্র বাহিনী’ (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী অথবা অপর কোনো
রাষ্ট্রীয় ইউনিট) যা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার জন্য গঠিত।
নির্যাতনের বিবরণ: জোরপূর্বক ঘটনার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি
বা অপর কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য অথবা স্বীকারোক্তি আদায়ে কোনো ব্যক্তি
অথবা তার মাধ্যমে অপর কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানো, বৈষম্যের ভিত্তিতে
কারো প্ররোচনা বা উস্কানি, কারো সম্মতিক্রমে অথবা নিজ ক্ষমতাবলে কোনো
সরকারি কর্মকর্তা অথবা সরকারি ক্ষমতাবলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকারী
ব্যক্তির এসকল কাজকে ‘নির্যাতন’ হিসেবে গণ্য করা হবে।
‘হেফাজতে মৃত্যু’ বলতে আইনে যা বুঝায়: ‘হেফাজতে
মৃত্যু’ বলতে সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু; এছাড়াও
হেফাজতে মৃত্যু বলতে অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক
গ্রেপ্তারকালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও বুঝাবে; কোনো মামলায় সাক্ষী হোক বা
না হোক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হবে।
অভিযোগ দাখিলের পর আদালতের করণীয়: নির্যাতন এবং
হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এর এখতিয়ারাধীন কোনো আদালতের সামনে কোনো
ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে উক্ত আদালত
তাৎক্ষণিকভাবে ওই ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করবেন; একজন রেজিস্টার্ড
চিকিৎসক দ্বারা অবিলম্বে তার দেহ পরীক্ষার আদেশ দেবেন; অভিযোগকারী মহিলা
হলে রেজিস্টার্ড মহিলা চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করবেন।
চিকিৎসক অভিযোগকারী ব্যক্তির দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং
নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখপূর্বক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর একটি রিপোর্ট
তৈরি করবেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক প্রস্তুতকৃত রিপোর্টের একটি কপি অভিযোগকারী
অথবা তার মনোনীত ব্যক্তিকে এবং আদালতে পেশ করবেন। চিকিৎসক যদি এমন পরামর্শ
দেন যে পরীক্ষাকৃত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রয়োজন তা হলে আদালত ওই ব্যক্তিকে
হাসপাতালে ভর্তি করার নির্দেশ প্রদান করবেন।
আদালত কর্তৃক মামলা দায়েরের নির্দেশ দান: আদালতে
অভিযোগকারীর বিবৃতি লিপিবদ্ধ করার পর আদালত যত দ্রুত সম্ভব বিবৃতির একটি
কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কাছে বা তার ঊর্ধতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার
কাছে পাঠাবেন এবং একটি মামলা দায়েরের নির্দেশ প্রদান করবেন। পুলিশ সুপার
উক্ত আদেশ পাবার পর পরই ঘটনা তদন্ত করে চার্জ (অভিযোগ) বা চার্জবিহীন
রিপোর্ট পেশ করবেন।
এখানে সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা অভিযোগকারী যদি মনে করেন যে,
পুলিশ দ্বারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয় সে ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যদি
আদালতে আবেদন করেন এবং আদালতে যদি তার আবেদনে সন্তুষ্ট হন সেক্ষেত্রে আদালত
বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ প্রদান করবেন।
পরে তদন্ত শেষে রিপোর্ট দাখিলের সময় তদন্ত কর্মকর্তা বা বিচার বিভাগীয়
তদন্ত কর্মকর্তার অধীনে বিবৃতি প্রদানকারী ব্যক্তিকে তারিখসহ রিপোর্ট দাখিল
সম্পর্কে আদালতকে অবহিত করবেন। তবে এ বিষয়ে নোটিশপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি
নোটিশ গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অথবা আইনজীবীর মাধ্যমে
আদালতে আপত্তি জানাতে পারবেন।
অ-জামিন যোগ্য অপরাধ: এই আইনের অধীন দণ্ডনীয় সকল অপরাধ
বিচারের জন্য গ্রহণীয় (Cognizable), অ-আপোষযোগ্য (non-compoundable) ও
জামিন অযোগ্য (non-bailable) হবে।
এসব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন ও অর্থদণ্ড: এই
আইনের অধীনে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড
অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর
অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে
ক্ষতিপূরণ প্রদান করবেন।
এছাড়াও কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত
নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে নির্যাতনকারী এই
আইনে অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য তিনি অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম
কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং
এর অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে
ক্ষতিপূরণ প্রদান করবেন।
এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে দণ্ড
ঘোষণার দিন থেকে ১৪ দিনের মধ্যে বর্ণিত অর্থ বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে।
আর তা না করা হলে এই আইনের আওতায় কোনো অপরাধের দণ্ডের বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তি
কোনো আপিল করতে পারবেন না।
এই আইনের অধীনে অপরাধের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করা
যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিরাও আপিল অথবা রিভিউর জন্য
ঊর্ধ্বতন আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
অপরাধের দায়ভার শুধুমাত্র ব্যক্তির উপর বর্তাবে: কোনো সরকারি কর্মকর্তা
অথবা তার পক্ষে কর্তব্যরত কোনো ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে
অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তার
বা তার পক্ষে কর্তব্যরত ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে ওই ক্ষতি
হয়নি।
EmoticonEmoticon